একজন ধূসর বিপ্লবী

দেশপ্রেম (ডিসেম্বর ২০১৩)

সাদিয়া সুলতানা
  • ১১
  • ১০
১.
জুনায়েদের হাতে রিমোট। যেন ১,২,৩,৪,৫,৬........শিখছে ছেলেটা। এমন চক্রাকারে চ্যানেল পাল্টাচ্ছে। সামাদ মিয়ার মাথা ঘোরে। উত্তাল হিন্দি গান, হিন্দি-বাংলা সিরিয়ালের থমথমে-অসম্পূর্ণ ডায়লগ, খেলার খবর, নিউজ চ্যানেল……চক্রাকারে ঘুরতেই থাকে।
-ও দাদু ভাই, এখানেই থাক। খবর দেখি।
সাড়ে তিন বছরের জুনায়েদ দাদুর চেয়েও গম্ভীর মুখে বলে ওঠে,
-আমিও তো খবর খুঁজছি, হরতাল….হরতাল.........হরতাল…..
হাসা উচিত না কাঁদা উচিত বুঝতে পারে না সামাদ মিয়া, শুধু নাতিকে পরম মমতায় বুকে টেনে নেয়,
-এসব বলে না, দাদু। আসো খবর শুনি।
জুনায়েদ আপোষহীন উত্তর দেয়,
-খবরে তো রোজ বলে, কেন, আজ হরতাল নাই?
নাতির কচি কন্ঠ ফাঁকি দিয়ে সামাদ মিয়ার কান সজাগ হয়ে ওঠে,
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামরিক প্রভৃতি ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগনের প্রতি যে সীমাহীন বৈষম্য সৃষ্টি করে, সেখানে ছয় দফা কর্মসূচি ছিল এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। আজকের এই দিনে লাহোরে বিরোধী দলগুলোর এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
মেকআপ লেপা মুখে কেমন রোবটের মত বলে চলে সংবাদ পাঠিকা। সামাদ মিয়ার সত্তরোর্ধ্ব গ্রীবা সচেতন হরিণের মত খাড়া হয়ে ওঠে। আজ ৫ ফেব্রুয়ারি নাকি? পেছনের ইতিহাস স্মৃতিতে দোল খায়। দেশ ভাগের ইতিহাস, দেশ স্বাধীন হওয়ার ইতিহাস। পুরনো ইতিহাস অথচ প্রাচীন বটগাছের মত ধৈর্য্যশীল, একরোখা।
-দাদু…ও দাদু…খবর দেখছো না? শেষ হয়ে গেল তো!
নাতির অস্থির ডাকের সাথে সাথে বর্তমানে ফিরে আসে সামাদ মিয়া। আজ তো সার্টিফিকেটের ব্যাপারে আবার জেলা শহরে যেতে হবে। মন্ত্রী মহোদয়ের বাড়ি। ব্যস্ত মানুষ। আজও ধরতে পারবে কিনা! দেরি হয়ে যাচ্ছে। ছোট খোকা সকালে নাস্তার টেবিলে বেশ অভিমান করেছে। হিস্ট্রি থেকে পাশ করে দুই বছর ধরে চাকরির অপেক্ষা। ছোট খোকা বরাবরই অশান্ত। তবু অনার্স-মাস্টার্স করে কাহাতক আর বসে থাকা যায়। ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে খুব একটা খারাপ রেজাল্টও না ছেলেটার। কোথায় কোথায় এ্যাপ্লাই করে চলে। ছেলেটার খুব শখ বাপের মত ৩য় শ্রেণীর কর্মচারি না হয়ে ১ম শ্রেণীর কর্মকর্তা হবে। এই সার্টিফিকেট ছাড়া নাকি লক্ষ্যভেদ হবেই না। বড় খোকাতো চাকরির ধারপাশ দিয়ে গেল না। ব্যবসায় মেতে গেল। এই মফস্বলেই দুই দুইটা কাপড়ের দোকান দিয়ে ছেলেটার ভালই চলছে। বুড়ো বাপ আর ভাই এর সাথে বেঈমানীও করেনি। দুই ছেলে নিয়ে আত্মতৃপ্তিই লাগে সামাদ মিয়ার। স্ত্রী শিমুলের মারা যাওয়ার শূণ্যতাও জুনায়েদ পূর্ণ করে দিয়েছে।
জুনায়েদ দাদার অন্যমনস্কতায় এবার ব্যস্ত হয়,
-দাদু…ও দাদু…রাগ করেছ? নাও রিমোট, তুমিই খবর দেখ। আমিও হরতাল দেখব…….
সামাদ মিয়া হেসে নাতিকে বুকে জড়িয়ে ধরে,
-আজ হরতাল নেইরে দাদু ভাই…
২.
বাস থেকে নামলেন সামাদ মিয়া। বড় রাস্তার ধারেই বাসটা তাকে নামিয়ে দিল।
-আাস্তে যান, চাচা মিয়া।
হেলপারের ঝাঁঝালো গলা শোনা যায়। মুহূর্তেই ধূলি উড়িয়ে বাসটা চলে গেল চোখের আড়ালে। রাস্তাঘাটে তাকে চাচা সম্বোধনই শুনতে হয়। বয়স তো আর কম হলো না, গুনে গুনে একাত্তর বছর। চুলগুলো তো ধূসর হতে শুরু করেছে অনেককাল আগে থেকেই। কিছুপথ হাঁটলেই বুকের ভেতর কনুই এর মাঝে চেপে রাখা ছাতাটা মেলে হাঁটতে শুরু করলেন তিনি। পিচ ঢালা রাস্তা সূর্যের তাপে যেন গলে গলে যাচ্ছে। এ রাস্তা পেরলেই মন্ত্রী মহোদয়ের বাড়ি। বিশাল মানুষের বিশাল বাড়ি। সামাদ মিয়ার গন্তব্যস্থান।
এ নিয়ে ছয় দিন এলেন তিনি, সন্তানের ভবিষ্যত উজ্জ্বল করার প্রত্যাশায়। পুরো জীবন একটা কাগজ ছাড়া পার করে দিয়ে আজ সেই কাগজের জন্যই মন্ত্রী মহোদয়ের বাসভবনের ভেতরের সুসজ্জিত অফিস কক্ষে বসে থাকাটা তার কাছে অবিশ্বাস্য লাগে। এই কাগজের গুরুত্ব আগে বুঝলে কবেই তো নিয়ে রাখতেন! বোকা সামাদ সাহেব ভেবেছেন ছাব্বিশে মার্চ আর ষোলই ডিসেম্বরে পাড়ার ছেলেরা অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিয়ে তাকে সম্মান করে এই তো ঢের! তিনি মুক্তিযোদ্ধা তার প্রমাণপত্র তো এই বিয়াল্লিশ বছর কাউকে দেখাতে হয়নি। নতুবা তার দরকারও পড়েনি। তবে আজ কেন দরকার হবে? মধুঘাটার মধুমাটিই তো তার ইতিহাসের সাক্ষী।
বিপদে পড়ে এখন ছোট খোকাই বুদ্ধিটা দিল। লোকাল মন্ত্রীসাহেব একটা সার্টিফিকেট দিলেও নাকি হবে। মন্ত্রী সাহেব এলাকায় খুব জনপ্রিয়। ঢাকা থেকে সপ্তাহ শেষে নিজ এলাকায় এসে সবার খোঁজখবর নেন। কিন্তু কথায় বলে না, সূর্যের চেয়ে বালি গরম!
অফিসকক্ষের পূর্বদিকের শেষ টেবিলটায় বসা ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে গেলেন সামাদ মিয়া। ভদ্রলোকের নাম, আহসান মোল্লা। প্রতিবারের মত আজও ভীষণ অবহেলায় আহসান মোল্লা তার দিকে তাকালেন,
-কী ব্যাপার?
আহসান মোল্লার প্রশ্নবোধক চোখ-মুখে তাকিয়ে সামাদ মিয়া উত্তর দেয়,
-স্যার, আমি মুক্তিযোদ্ধা সামাদ মিয়া, ঐ স্যার মধুঘাটা গ্রামের, আমার সার্টিফিকেটের ব্যাপারটা...মন্ত্রী স্যারের সাথে একটু দেখা করিয়ে দেন না... আমার ছেলে বলেছে তিনি এই কাগজটায় সাইন দিলেও চলবে…।
ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠের সাথে মাথাটাও নুয়ে আসে সামাদ মিয়া। একটানা কথা বলে হাঁপাতে থাকেন। নিজেকে একটা ভিখারির মত মনে হয় তার। ভরদুপুরে কোন ভিখারির নিরবচ্ছিন্ন কড়া নাড়ায় খুব বিরক্তি নিয়ে যেভাবে সকলে দরজা খোলে, ঠিক তেমনি তার দিকে তাকালেন ভদ্রলোক।
-আহ, রোজ রোজ ক্যানো বিরক্ত করেন ভাই? মন্ত্রী স্যারের কি আর কোনো কাজ নাই? যত্তোসব...মুক্তিযোদ্ধা না ছাই...আজকাল সবাই মুক্তিযোদ্ধা...যান.. যান ঐ চেয়ারটায় বসেন।
অফিসকক্ষের পশ্চিম কোণে রাখা নড়বড়ে চেয়ারটায় বসে ঘরের চারপাশ দেখতে থাকেন সামাদ মিয়া। লোকজন ঢুকছে, বেরুচ্ছে। কতো কাজ কতো ব্যস্ততা সকলের। সামাদ মিয়ার পাশের চেয়ারে একটি অল্পবয়সী ছেলে বসে আছে। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়স হবে।
-চাচা, আপনারও কি একই কেস? ছেলের চাকরি? আমি অবশ্য আমার চাকরির তদবিরে আসছি। আমার বাবা আবার মন্ত্রীর স্কুল জীবনের বন্ধু। বাবা বিছানায় পড়া। দেখি স্যারের বাবার কথা মনে আছে নাকি!
ছেলেটার চোখে মুখে কৌতূহল। সামাদ মিয়া উত্তর দেন না। তাকে নিশ্চুপ দেখে ছেলেটি আবার কথা বলে,
-চাচা…টেনশন কইরেন না। বড় মানুষের সাথে দেখা করতে একটু কষ্টই। তবে আমিও ঠিক করছি আইজ দেখা না কইরা যাব না।
মাথার উপর একটা ফ্যান ঘুরছে বিচ্ছিরি ঘটাং ঘটাং শব্দে। তবুও ঘামতে থাকেন তিনি। ঘড়ির দিকে তাকান। ডায়ালটা ঝাপসা লাগে। ভেতরে পানি ঢুকেছে বোধহয়। নাকি এবার চোখের আলোও কমে এল। বারোটায় এসেছেন, এখন পৌনে একটা বাজে। মধুঘাটা যাবার পরের বাস দেড়টায়।
-এই যে সামাদ মিয়া, কাছে আসেন।
মন্ত্রী মহোদয়ের সহকারী চাপা গলায় ডাক দেয়,
-শুনুন, খুব তাড়াতাড়িই স্যারের দেখা পেয়ে যাবেন। স্যার ব্যস্ত মানুষ। কত অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকে বোঝেন না। আরে পেয়ে যাবেন… তা অনেকদিন ধরেই ভাবছি ঘরের জন্য একটা আলমারি কিনব, মোটে আট হাজার টাকা দাম...আপনি কিছু আগায় দেন আরকি….
ভ্রু দুটো কুৎসিত ভঙ্গিতে নাচাতে থাকেন ভদ্রলোক। ফ্যান ঘোরার শব্দটা কেমন বেড়ে যায় হঠাৎ। উঠে দাঁড়ান সামাদ মিয়া। একটু আগে ঘামতে থাকা হাতের মুঠো নিজে থেকেই শুকিয়ে আসে।

মধুঘাটার বাস আসার সময় হয়ে এলো।

আপনার ভালো লাগা ও মন্দ লাগা জানিয়ে লেখককে অনুপ্রানিত করুন
এস, এম, ইমদাদুল ইসলাম বোন আপনাকে সালাম জানাই । আজকাল মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান করতে গিয়ে যেভাবে তাদেরকে পরোক্ষ অসম্মান উপহার দেয়া হয়েছে সেটাকে তুলে ধরার জন্য একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে ধন্যবাদ জানাচ্ছি । আর রাজনৈতিক কারণে আমার চার বছরের মেয়েটাও গল্পের শিশুর মতই মানসিকভাবে অন্য রকম জগতে নিপতিত হয়েছে । যা সত্যিই আশংকাজনক ।
ভালো লাগেনি ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৩
ধন্যবাদ। আপনার বাবা আমাদের অহংকার। ভাই আমার চার বছরের ছেলেরও একই অবস্থা। এদের নিয়ে কী যে করি!!!
ভালো লাগেনি ২৮ ডিসেম্বর, ২০১৩
এশরার লতিফ ভালো লাগলো গল্পটি.
ভালো লাগেনি ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৩
আন্তরিক ধন্যবাদ ও অশেষ শুভকামনা।
ভালো লাগেনি ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৩
জাজাফী আপনার লেখাটি বেশ সাবলিল ও সুন্দর হয়েছে।
ভালো লাগেনি ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৩
আপনি কী ছোটদের বন্ধুর জাজাফী? যদি তাই হন তবে স্যালুট টু ইউ। পত্রিকাটা পড়ছি। ভাল লাগছে। অশেষ ধন্যবাদ।
ভালো লাগেনি ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৩
মিলন বনিক সুন্দর আর সাবলীল শিল্প মান সম্মত একট গল্প উপহার দিয়েছেন....পাঠক মুগ্ধ....
ভালো লাগেনি ২৩ ডিসেম্বর, ২০১৩
খুব দ্রুত লেখা। পোস্ট দেওয়ার পরে আরও এডিট করেছি। যে মায়া বা শ্রম দেওয়া উচিত ছিল তা দিতে পারিনি। তবু আপনার মত গল্পকারের মুগ্ধতা পেয়ে ভাল লাগছে। লেখালেখির জগতে আপনার উপস্থিতি আরও সরব হোক।
ভালো লাগেনি ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৩
মোহাম্মদ ওয়াহিদ হুসাইন সত্যিকারের মুক্ত জীবন!!! যে খামচাতে পারছে সে-ই পাচ্ছে...। বাস্তবতা তুলে এনেছেন। শুভেচ্ছা রইল।
আপনার সুন্দর মন্তব্যের পেছনেও অনেক বাস্তবতা রয়েছে। ধন্যবাদ।
এফ, আই , জুয়েল # লেখার থীম , ষ্টাইল ও এর গতিময়তা বেশ চম?কার । অনেক সুন্দর । ধন্যবাদ ।।
ধন্যবাদ। মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি তবু তার চেতনা ধারণ করতে চাই। আপনার মন্তব্য আমার উৎসাহ বাড়িয়ে দিল।
মোঃ আক্তারুজ্জামান নীতি আদর্শ ধুলোয় মিশিয়ে সামনে আগানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতার বিপরীত ধারায় এগিয়ে যাবার মানুষ সামাদ মিয়া। সুন্দর চরিত্র চিত্রণ। খুব ভাল লাগল।
ধন্যবাদ। ভালো লাগা অব্যাহত থাকুক......শুভকামনা।
Rumana Sobhan Porag সাদিয়া আপা খুব ভাল লিখেছেন । অনেক শুভ কামনা আপনার জন্যে।
ধন্যবাদ। আপনার ভালোলাগা আমার অণুপ্রেরনা।
হাবিব রহমান আরেক যুদ্ধ, প্রকৃত যোদ্ধা কখনো পরাজিত হয়না। শুধু পথচলা কষ্টকর হয়ে যায়। গল্প চমৎকার।
আরাফাত ইসলাম চাঁছা-ছোলা বাস্তবতাটা অনেকে এড়িয়ে যায় ! অনেকের প্রকাশ করার সাহস থাকে না !! আপনি দুটোর একটিও করেন নি !!!
আপনিও বেশ চাঁছা-ছোলা মন্তব্য করেন আরাফাত ভাই। এই সাহসও সবার থাকে না। লেখার ভুল ধরিয়ে দিলে আরও সমৃদ্ধ হব।

১৯ অক্টোবর - ২০১৩ গল্প/কবিতা: ২১ টি

বিজ্ঞপ্তি

এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।

প্রতি মাসেই পুরস্কার

বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।

লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন

  • প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
  • তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।

আগামী সংখ্যার বিষয়

গল্পের বিষয় "ছোটবেলা”
কবিতার বিষয় "ছোটবেলা”
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ ডিসেম্বর,২০২৪